সমরেশ মজুমদারের উত্তরাধিকার উপন্যাসের রিভিউ
শুরুতেই ডুয়ার্সের স্বর্গছেঁড়া চা বাগানের প্রাকৃতিক বর্ণনা চমৎকারভাবে এসেছে যেটার আবহে আপনি বইটির প্রথম দশ পৃষ্ঠা নিমিষেই পড়ে ফেলবেন!
ছোট্ট অনিমেষ অতি নৈসর্গিক, অতি মনোরম স্বর্গছেড়ার চা বাগান ও লাগোয়া আঙ্গরভাসা নদীর কুল দিয়ে ছুটাছুটি করে বেড়াচ্ছে।
উপন্যাসের শুরুতে বোঝার উপায় নেই যে এতে সমরেশ মজুমদার ইতিহাসের একটা বিরাট উল্লেখযোগ্য সময়কে ধরতে চলেছেন।
বলছি “উত্তরাধিকার” উপন্যাসের কথা।
এই চা বাগানে অনিমেষের দাদা সরিৎশেখর বাগানের জন্মলগ্ন থেকে চাকরি করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তার চাকরি শেষ হয়ে যাবে। তাকে বিদায় দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। তিনি চাকরি শেষ করে পেনশান নিয়ে চলে যাবেন জলপাইগুড়িতে। সাথে যাবে তার একমাত্র পৌত্র অনিমেষ আর তার বিধবা মেয়ে হেমলতা।
চলে যাওয়ার ব্যাপারটাকে সমরেশ মজুমদার যে আবেগ দিয়ে বর্ণনা করেছেন তাতে মন-ঠন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় চাকরি শেষেও তিনি এখানেই থেকে যাক। এত ভালবাসা, মধুর স্মৃতি সব পেছনে ফেলে বুকভরা কষ্ট নিয়ে যাওয়ার কোন মানে নাই!
এদিকে ১৯৪৭ এর ১৫ ই আগস্ট অতি সন্নিকটে। চারিদিকে সাজ সাজ রব, চোখেমুখে সবার আনন্দ। দুশো বছরের ইংরেজ শাসন শেষে ভারত স্বাধীন হতে যাচ্ছে।
স্বাধীনতার কৃতিত্ত্ব কংগ্রেসের। ছোট্ট অনিমেষের স্কুল শিক্ষক দেশের স্বাধীনতা আর কংগ্রেসকে ইতিমধ্যে এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছেন। “বন্দেমাতরম্” শুনলে অনিমেষের লোম দাড়িয়ে যায়।
১৫ ই আগস্টের অনুষ্ঠানে সুদূর কলকাতা থেকে কংগ্রেসের একজন বড় নেতা আসছেন এই স্বর্গছেড়ায়। ঐদিন খুব ভোরে পতাকা উত্তোলন হবে। বন্দেমাতরম্ ধ্বনিতে মুখরিত হবে চারিদিক।
অনিমেষ ও তার বন্ধুদের মধ্যেও প্রচুর উত্তেজনা।
১৫ই আগস্ট সকালে সবাই দলবেধে স্কুল মাঠে হাজির হয়। কলকাতা থেকে আসা কংগ্রেস নেতা অনিমেষকে দিয়ে পতাকা উত্তোলন করান।
এই ঘটনা এবং অনিমেষের স্কুল শিক্ষকের পুন: পুন: কংগ্রেসী বয়ানে অনিমেষ তার অবচতেনেই শৈশবের স্বাভাবিক কৌতুহল থেকে রাজনীতি ও দেশকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে। অনিমেষের শিক্ষক দেশকে মায়ের মত ভালবাসার শিক্ষা দেন।
অনিমেষ চলে যায় তার দাদার সাথে জলপাইগুড়িতে। তাকে লেখাপড়া করে অনেক বড় হতে হবে। অনিমেষের বাবাও স্বর্গছেড়া চা বাগানে চাকরি করেন। মা বাবা কে স্বর্গছেড়ায় রেখে অনিমেষ জলপাইগুড়িতে চলে যায়।
জলপাইগুড়ি চলে যাওয়ার কিছুদিন পর অনিমেষের মা-বাবা সেখানে বেড়াতে যান। তখন অনিমেষের অন্তসত্ত্বা মা সেখানেই মারা যান। খুব দুঃখজনক ব্যাপার!
অনিমেষ স্বর্গছেড়া থাকতেই কংগ্রেসের বাইরে আরেকটি দলের আভাস পায়।
“এ আজাদি ঝুটা হ্যায়”, “ইনকিলাব, জিন্দাবাদ” এই স্লোগানের সাথে অনিমেষ স্বর্গছেড়ায়ই পরিচিত হয়। অনিমেষ পরে জানতে পারে এরা কম্যুনিস্ট।
বইয়ের এই সময়কালটা ১৯৪৫ সালের।
১৯৪৫ সালের পরে প্রায় দশবছর সময়কালের কথা লেখক এই বইতে বলেছেন। তিনি ইতিহাস বলেননি। বরং তিনি এই সময়টাকে দেখিয়েছেন একজন কিশোরের তথা অনিমেষের দৃষ্টি দিয়ে। অনিমেষের সাথে বইয়ের কাহিনী এগিয়েছে।
অনিমেষ মেধাবী, সাহসী, কোতুহলী, সৎ, রাজনীতি সচেতন ও পরোপকারী। ছোটকালে মাকে হারালেও সে দেশকে মায়ের মত ভালবাসতে চায়। কিন্তু রাজনীতির মাঠে তার চিন্তাজগত বারবার হোঁচট খেয়েছে।
অনিমেষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে রাজনীতির হিপোক্রেসিগুলো তার চোখে ধরা পড়তে থাকে। মহত্মা গান্ধীর কংগ্রেসের নৈতিক অবক্ষয় তার সামনে আসতে থাকে। কম্যুনিস্টদের কথা তার ভালো লাগে। তাদের মুলনীতি তাকে আকৃষ্ট করে। এদিকে স্বাধীনতা যাদের হাত ধরে এসেছে তাদের ত্যাগও সে অস্বীকার করতে পারে না।
এই বইয়ের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অনিমেষের দাদা সরিৎশেখর। তিনি ইংরেজ আমলের অল্প শিক্ষিত হলেও তার অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক বড়। তিনি অনেক ইংরেজ বড় অফিসারদের সাথে কাজ করেছেন। নিজ কর্মস্থলে সারাজীবন সৎ থেকেছেন। তিনি বাঙ্গালী টিপিক্যাল ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ মানুষ। সস্তা আবেগগুলো নিজের মধ্যে চাপা দিয়ে জীবনের এতটা পথ চলে এসেছেন।
এছাড়াও এই বইতে আছে আরো অনেকগুলো চরিত্র। সব চরিত্রই মনে মৃদু ব্যাথা দেওয়ার মত।
এই বইয়ে তখনকার স্বর্গছেড়ার চা বাগান ও জলপাইগুড়ির দৈনন্দিন জীবনের বর্ণনা খুবই হৃদয়স্পর্শী। একাজে সমরেশ মজুমদার বরাবরই দক্ষ।
অনিমেষের চলার পথের সাথেই লেখক তার বর্ণনার হুইল ঘুরিয়েছেন। স্বর্গছেড়া এবং জলপাইগুড়ি উভয় জায়গাতেই অনিমেষের সমবয়সী বন্ধু বান্ধব ও পরিচিতজনদের বর্ণনা আছে।
অনিমেষ জলপাইগুড়িতে এসে জেলা স্কুলে ভর্তি হয়। এখান থেকে ভালো রেজাল্ট করে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় যেতে হবে এটাই তার ও তার দাদা সরিৎশেখরের স্বপ্ন। অনিমেষের গোষ্ঠি থেকে কেউ কখনো কলকাতায় পড়তে যায়নি। পরবর্তীতে অনিমেষের স্বপ্ন পূরণ হয়। সে ফার্স্ট ডিভিশান পেয়ে কলকাতায় পড়তে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ক্যাপিটালিজম ও কম্যুনিজম নিয়ে যে কোল্ড ওয়ার শুরু হয় তার উপমহাদেশীয় প্রাথমিক আঁচ এই বইটাতে মোটামুটি পাওয়া যায়। তখনকার কিছু যুবক কার্ল মার্কসকে ধারণ করে সর্বহারাদের সাথে নিয়ে তাদের অধিকারের জন্য বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে দাড়ানোর যে প্রবণতা দেখিয়েছে এটাই পরবর্তীতে এ উপমহাদেশে বিস্তার লাভ করে। নকশাল, সর্বহারাদের এই উপস্থিতি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও খুব ভালোমত লক্ষ্য করা যায়। যদিও কার্ল মার্কসের মূলনীতি থেকে বেরিয়ে তা পরবর্তীতে একসময় নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠনে কিছুক্ষেত্রে রূপ নিয়েছিলো।