ফ্রেমিং ইফেক্ট: যা ব্যবহারে আপনার লক্ষ্য অর্জন হবে আরো সহজ
ফ্রেমিং ইফেক্ট কমিউনিকেশান ভালো করার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের জুয়েলারী দোকান দেখলেই নাক সিটকানো বা “হুদাই পয়সা খরচ” শব্দবন্ধটা মাথায় আসা অস্বাভাবিক না। শুধু শুধু লাখ টাকা খরচ করে চুরি, নেকলেস, ব্রেসলেট মেয়েরা কেন বানায় বা গার্লফ্রেন্ড বা বউ কেন চায় এটা সচেতনে বা অচেতনে কিছুটা হইলেও তাদের বিরক্তি উদ্রেক করতে পারে।
কিন্তু কোন জুয়েলারী দোকানের ট্যাগ লাইন যদি হয় “আজকের বিলাসিতা আগামী দিনের সঞ্চয়” তাহলে এমন ছেলেরাই লাইনটা দ্বিতীয়বার দেখে এবং তৃতীয় ধাপে নিজের মনে লাইনটা আউড়িয়ে বিষয়টা চিন্তা করে এবং বউকে ছোট বাজেটের হলেও কিছু অলংকার দেওয়ার স্বপ্ন দেখা যদি শুরু করে তাহলে এটাতে অস্বাভাবিকতার আর কিছু থাকে না।
বিষয়টা হচ্ছে, আপনি “কী” বলছেন তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি “কীভাবে” বলছেন। কথা বলার ভিন্নতার দ্বারা শ্রোতা একই তথ্য ভিন্নভাবে গ্রহণ করে। কোন সিচুয়েশান কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে সেটার বেসিসেই আমরা রিয়াক্ট করি।
শব্দবন্ধের এই যে পরিবর্তন, বা একই কথা একটু অন্যভাবে বলা এটাকে বলা হয় “Framing”.
Daniel Kahneman এবং Amos Tversky দুইজন সাইকোলোজিস্ট ১৯৮০ সালে এপিডেমিক কন্ট্রোল স্ট্রাটেজির আওতায় দুটি অপশন সামনে রেখে একটি জরিপ পরিচালনা করেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বলা হয়, মনে করেন “৬০০ লোকের জীবন বিপন্ন” । এমতাবস্থায়,
অপশন A এপ্লাই করলে ২০০ মানুষ বেঁচে যাবে।
অপশন B এপ্লাই করলে ৩৩% সম্ভাবনা যে ৬০০ মানুষ বাঁচবে এবং ৬৬% সম্ভাবনা যে কেউ বাঁচবে না।
কোন অপশনটি অংশগ্রহণকারীদের পছন্দ সেটি জানতে চাওয়া হয় এবং অধিকাংশ অংশগ্রহণকারীই অপশন A পছন্দ করেন।
অথচ A এবং B দুটি অপশনেই মূলত একই কথা বলা হয়েছে যেখানে বেঁচে যাওয়া মানুষের প্রত্যাশিত সংখ্যা হবে ২০০ জন।
এ দুটি অপশনই আবার একটু অন্যভাবে ঘুরিয়ে বলে তারা ভিন্ন রেজাল্ট পান। এক্ষেত্রে বলা হয়,
অপশন A এপ্লাই করলে ৪০০ মানুষ মারা যাবে।
অপশন B এপ্লাই করলে ৩৩% সম্ভাবনা যে ৬০০ জনের কেউই মরবে না এবং ৬৬% সম্ভাবনা যে সবাই মারা যাবে।
এক্ষেত্রে অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী অপশন B পছন্দ করেন।
“মরা” এবং “বাঁচা” শব্দ দুটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম ফলাফল পাওয়া গেলো।
Daniel Kahneman এবং Amos Tversky তাদের গবেষণায় বলেছেন, “ইতিবাচকভাবে বা ইতিবাচক শব্দ বা তথ্য দ্বারা যখন Framing করা হয় তখন মানুষ ঝুঁকি নিতে চায় না, কিন্তু নেতিবাচকভাবে বা নেতিবাচক শব্দ বা তথ্য দ্বারা যখন Framing করা হয় তখন মানুষ ঝুঁকি নেয়।”
উপরোক্ত উদাহরণের প্রথম ফেইজে “বাঁচা” শব্দ দ্বারা Framing করায় অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী অপশন A তথা “২০০ মানুষ বেঁচে যাবে” এটিই গ্রহণ করেছে এবং দ্বিতীয় ফেইজে “মরা” শব্দ দ্বারা Framing করায় অপশন A তথা ডিরেক্ট “৪০০ মানুষ মারা যাবে” অপশনটির চেয়ে একটু ঝুঁকি নিয়ে অপশন B পছন্দ করেছে। যদিও উভয় ক্ষেত্রে একই রেজাল্ট পাওয়া যাবে।
Framing Effect এর আরেকটি উদাহরণ এমন হতে পারে যে দুটি প্যাকেটজাত মাংস বা ইয়োগার্টের একটির গায়ে “৯০% ফ্যাট ফ্রি” এবং অন্যটির গায়ে “১০% ফ্যাট” লেখা থাকলে প্রথমটাকেই বেশি স্বাস্থ্যকর মনে হয়। যদিও উভয় প্যাকেটের মাংসেই ফ্যাটের পরিমাণ একই।
এটি এমন একটা কগনিটিভ বায়াসনেস যেখানে মানুষ ইতিবাচক বা নেতিবাচক শব্দবন্ধের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেন। যেমনঃ
“বাঁচা” আর “মরা”
“লাভ” আর “ক্ষতি”
“ফ্যাট ফ্রি” আর “ফ্যাট” ।
“সম্ভাব্যতা”র থিওরি মতে কোন কিছু পাওয়ার চেয়ে কোন কিছু হারানোর ব্যাপারটা মানুষের জন্য বেশি কষ্টদায়ক তাই সাধারণত মানুষ ঝুঁকি নিতে চায় না। যেকারনে কোন কিছু পাওয়া বা না পাওয়ার ক্ষেত্রে ফিফটি ফিফটি চান্স থাকলে মানুষ সাধারণত এই ধরনের অপশনে কোনটাই পছন্দ করার পক্ষপাতি হয় না। কারন তারা কোন কিছু পাওয়ার চেয়ে কোন কিছু না হারানোটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
Framing Effect হলো দুটি অপশন সামনে রেখে কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেখানে উভয় অপশনেরই আউটপুট সেইম। আপনি যে অপশনই পছন্দ করেন না কেন তাতে ফলাফলের কোন হেরফের হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমরা সেই অপশনটিই পছন্দ করি যেটা Positively Framed বা Risk Free.
কোন একজন ক্যন্সারের ডাক্তার যদি সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা তার কোন রোগীকে “আপনি কেমোথেরাপি নিলে আপনার মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ১০ ভাগ” না বলে যদি এভাবে বলেন “আপনি কেমোথেরাপি নিলে আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৯০ ভাগ” তাহলে রোগী কেমোথেরাপি নেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিবেন। বক্তব্য একই কিন্তু Framing Effect এর কারনে রোগী দ্রুত, নির্ভয়ে এবং আস্থার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
শব্দবন্ধ পরিবর্তন করে বা একটু ঘুরিয়ে বলার পাশাপাশি Visual Framing তথা লেখার রং, ফন্ট, স্টাইল বা বলার ক্ষেত্রে সেটা জোর দিয়ে বা আস্তে বলা ইত্যাদি ভেরিয়েবল নিয়েও Framing Effect এর আলোচনা বিস্তৃত।
দুটি বিষয়ের মধ্যে যে কোন একটি পছন্দ করতে হবে এমন অবস্থায় শ্রোতার নিকট থেকে সিদ্ধান্ত জানতে বিষয়গুলো কোন টোনে তথা “উঁচু স্বরে জোর দিয়ে” নাকি “নরম সুরে হালকাভাবে” তার নিকট উপস্থাপন করা হচ্ছে সেটার উপরে নির্ভর করে উত্তরদাতা কোন সিদ্ধান্তটি নিতে যাচ্ছেন।
একই কথা মিন মিন করে বলা আর আত্মবিশ্বাসের সাথে স্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে বলার মধ্যে যে অনেক পার্থক্য আছে এটা তো সহজেই অনুমেয়। এই দুইভাবে বলাটাও দুইরকমের Framing.
রাস্ট্রীয় জীবন থেকে শুরু করে ব্যক্তি জীবন পর্যন্ত এমনকি অর্থনীতি, বিজ্ঞান, সেলস এন্ড মার্কেটিং, কূটনীতি, রাজনীতি, নেগোসিয়েশান, কনসালটেন্সিসহ সম্ভাব্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সবক্ষেত্রেই Framing Effect ব্যবহৃত হয়। লেখক তার লেখায়, পরিচালক তার সিনেমায় এভাবে প্রতিটি সৃষ্টিতেই তার স্রষ্টা এটা ব্যবহার করেন। একই প্লট ভিন্ন ভিন্ন লেখক বা পরিচালকের হাতে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় আকর্ষনীয় বা গ্রহণীয় হয়ে ওঠে।
আপনি যদি একেবারেই নতুন কবি হন এবং জীবনানন্দ দাশের কোন কবিতা যদি কোন প্রকাশক বা সম্পাদকের কাছে যেয়ে সেটা নিজের কবিতা বলে প্রকাশের আবেদন করেন তাহলে প্রকাশক বা সম্পাদক কবিতা দেখে সেটা প্রকাশ করার ব্যাপারে গড়িমসি করবেন এজন্য যে আপনি নতুন কবি হিসেবে আপনার কবিতা হয়ত যথেষ্ট মানসম্মত না। অর্থাৎ আপনার কবিত্বের Framing মার্কেটে ঐ পর্যায় যায় নাই যে আপনি কবিতা নিয়ে গেলেই সেটি ছেপে দেওয়া হবে। অথচ হালের কোন প্রখ্যাত কবি যে কোন কবিতা উক্ত লেখক বা প্রকাশকের কাছে পাঠালে তিনি হয়ত কবিতা না পড়েই প্রকাশের অনুমতি দিয়ে দিবেন।
সুতরাং Framing Effect আমাদের জীবনের সবক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের ব্যক্তিজীবন বা পেশাগত জীবনে এটা পজিটিভলি কাজে লাগিয়ে আমাদের সামনে থাকা প্রতিটি লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টার চর্চা করাটা একটি যথার্থ ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত হতে পারে।